অনির্ধারিত

জমজ জরায়ুর গল্প

জমজ জরায়ুর গল্প
আমি দক্ষিণ এশিয়ার একটি ধার্মিক পরিবারের বেড়ে উঠেছি। সুতরাং পুরোটা ব্যপারটা আপাতঃদৃষ্টিতে খুব কঠিন ছিলো আমার জন্য। হবে না কেন? নারী বলে যেমন আকাশে উঠিয়ে ভাবতে পছন্দ করে, আবার আমাদের সমাজ আমাদেরকে রোজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের ঠুনকো সম্মান আসলে কতটা নড়বড়ে। এমন একটা সমাজে খুব অচেনা একটা ‘স্ত্রী-রোগ’ কেউ খুব সহজে কাউকে বলতেই চাইবে না। অথচ সমস্যাটা এত জটিল ছিলো, কেবল এর পরিচয়টা বের করতেই সাড়ে তিন বছর সময় চলে গেছে। তদ্দিনে আমি একাধিকবার গর্ভপাতের তিক্ত স্বাদ চেখে দেখে ফেলেছি। না, অভিজ্ঞ ডাক্তাররা জানেন না, এমনকি গুগল করেও কিচ্ছু জানা যাচ্ছিলো না। সহজ ভাষায় মেয়েদের প্রজননতন্ত্রের গঠনটা বলতে গেলে এমন, দু’টা ডিম্বাশয় থাকে যাতে উৎপন্ন হওয়া ডিম্বানু দিটো আলাদা পথে একটিমাত্র যে জরায়ু থাকে তাতে এসে পড়ে। আমার অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যটা এটাই, আমার জরায়ু একটার জায়গায় দু’টো। চিকিৎসাবিজ্ঞান এর নাম দিয়েছে ‘ইউটেরাস ডিডেলফি’ বা জোড়া জরায়ু। শতকরা মাত্র ০.১ থেকে ০.৫ জনের এ বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। তার মানে আমি এক লক্ষ মহিলার মধ্যে সেই একজন, যার মধ্যে জোড়া জরায়ু পাওয়া গেছে। এর একটা কারণ হতে পারে, নিয়মিত গড়নের জরায়ুর পাশে আরেকটা অপুষ্ট জরায়ু জন্মেছে যার মধ্যে ডিম্বানু আসার পথটাও আলাদা। আমার ব্যপারটা আরও ভিন্ন, কারণ আমার প্রতিটা জরায়ুতে একটি করে ডিম্বাশয় আলাদা আলাদা পথে যুক্ত। কি কি প্রশ্ন এসেছে এই বৈশিষ্ট্যটুকু জানার পর? সচরাচর আমাকে করা প্রশ্নগুলোর জবাব মোট পাঁচটা ভাগে লিখছিঃ ১। এটা রোগ নয়, জন্ম থেকেই ধারণ করা জীনগত বৈশিষ্ট্য। হ্যাঁ, অন্যদের মত সব নিয়মমত সাজানো থাকলে আমারও ভালো লাগতো। কিন্তু এখন আমি আমার এ ব্যপারটাকে মেনে নিতে শিখে গেছি। কিছু ব্যপারে ব্যতিক্রম ছাড়া আমি একজন স্বাভাবিক মহিলা। বয়ঃসন্ধির সময়টায় আমার মাসের নির্দিষ্ট সময়ে জ্বর, প্রচন্ড পেটব্যথা, বমি হতো। আর তার ওপর বাড়তি ছিলো প্রবল স্রাব। এমনকি সে সময়টা ছাড়াও পেটের পেশীর আচমকা টান খুব কষ্ট দিতো। ডাক্তার বলতেন, পেটে গ্যাস, সেরে যাবে। গালের ব্রণ, পেটের অকারণ তীব্র ব্যথা এই নিয়ে আমি আমার সেই কৈশোরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এমনকি প্রথমবার আমার না আসা সন্তানের গর্ভপাতের পর ডাক্তারের মতে সেটাও ‘স্বাভাবিক’ ঘটনাই ছিলো। দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তি হতে আমার মা উদ্বিগ্ন হয়ে গেলেন। মেয়ে আর জামাইকে বাধ্য করলেন আসল কারণ খুঁজে দেখতে। সাড়ে তিন বছরের সুদীর্ঘ সেই আত্ম-আবিষ্কারের যাত্রার পর, আলহামদুলিল্লাহ, আমি আজকে একজন গর্বিত মা। ২। জোড়া জরায়ু আসলে গর্ভধারণে কোন সমস্যা তৈরী করে না, শুনতে যা ই মনে হোক না কেন। কারণ, সংখ্যায় যাই হোক, ডিম্বাশয়গুলো প্রত্যেক মাসে নিয়ম করে সাইকেল পূর্ণ করছে। সমস্যাটা শুরু হত গর্ভধারণের পর। একটা থাকার কথা, সে একই জায়গায় দু’টো জরায়ু। জায়গার বরাদ্দ কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং ভ্রূণ অন্যদের মত জায়গা পাচ্ছে না বেড়ে ওঠার। একটু বড় হতেই স্থান সংকুলান না হওয়ায় হিসেবের নয়টা মাস বাচ্চা জরায়ুতে থাকতে পারছে না। এমন মায়েদের সাধারণত গর্ভপাত হয়ে যায় কিংবা সময়ের আগে বাচ্চা বের করে ফেলতে হয়। ছেলে জন্মানোর আগে আমি প্রতি মুহূর্তে তৈরি থাকতাম ডাক্তারের কাছে দৌড়ানোর জন্য। কারণ আমি জানিনা আমি ওকে কতক্ষণ জায়গা দিতে পারবো। এক একটা সপ্তাহ ছিলো যেন টাইম বোমা। অবশেষে ২৮ সপ্তাহে ছেলের মুখ দেখি, গর্ভধারণের মাত্র সাত মাস পার হতেই। ৩। দু’টো সুস্থ সক্রিয় জরায়ু মানে কিন্তু অন্য একটা ব্যপারও আছে। হ্যাঁ, জমজ সন্তানের সম্ভাবনা আছে। মজা অরে জিগেস করা হলেও এ প্রশ্নের উত্তরটা অত মজার না। যদিও সচরাচর হওয়ার সম্ভাবনা কম, একই সাথে দু’টো বাচ্চা আলাদা আলাদা জরায়ুতে বেড়ে উঠতে দেয়া মানে উপরে দুইনং এ বলা সমস্যাটা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। এম্নিতেই বাচ্চাসহ জরায়ুটা বেড়ে ওঠার সময়টাতেই অন্য জরায়ুকে ধাক্কা দিচ্ছিলো। একটা সময় আমি সত্যিই টের পেতে শুরু করেছিলাম, পেটের মধ্য থেকে একটা জমে থাকা বস্তু ওপরে চাপ দিচ্ছে। মাঝেমাঝে চাপটা এসে পড়তো ফুসফুসের ওপরে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হত। গর্ভধারণের সময়ে এটা অনেকের এম্নিতেই হয়, আর আমার জন্য কষ্টের মাত্রাটাও বেশি ছিলো। মাত্র চব্বিশ সপ্তাহ পার হতেই আমি অভিযোগ করতাম, আমার পেটটা মনে হয় ফেটেই যাবে! এখন ভয় লাগে, যদি দুইটাতে আলাদা দুইটা বাচ্চা থাকতো, কি করতাম? ভাবতে পারেন? দুইটা জরায়ুতে দুইটা বাচ্চা মানেই, তাদের বৃদ্ধি এবং বয়স আলাদা। মনে করা যাক, একজনের বয়স ১৮ সপ্তাহ আরেকজনের ২৪। মাত্র কয়েক সপ্তাহের তফাতে দুইবার প্রসব। ভাবা যায় না! ৪। পুরো গর্ভধারণের সময়টায় আমার পিরিয়ডও হয়েছে আগের মতই। অন্যান্য গর্ভবতী মহিলাদের মত অন্তত এই নয়টা মাস পিরিয়ডের অস্বস্তি থেকেও অবসর ছিলো না। তাহলে বাচ্চা আসার কথা বুঝলাম কি করে? স্বভাবজাত অস্বস্তি থেকে। কারণ অনিশ্চয়তায় অনেক দিন থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে মানুষ তার মনের সামান্যতম খুঁতখুঁতিকেও আমল না দিয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু পরের ঘটনা পরম্পরা এতোই অকল্পনীয় ছিলো, না ডাক্তার সেটা আগে বুঝতে পেরেছিলেন, না আমি। রক্ত দেখে প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছিলাম, মনে হল আবার একটা বাচ্চা আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন আল্লাহ। আবার সেই ইমার্জেন্সিতে দৌড়, টেস্ট, ওষুধ এবং একদম পুরোপুরি বেড রেস্টের পরামর্শ পেলাম। একই ঘটনা ঘটতে থাকলো কয়েক সপ্তাহ পরপর। এর কারণ? ডাক্তার মাথা চুলকেছেন, কারণ জানা নেই। মজার ব্যপার হলেও, সত্যিটা আমিই ভেবে বের করেছিলাম।প্রত্যেকবার ইমার্জেন্সিতে যাওয়ার তারিখ, সেসময়ের লক্ষণগুলো সব মিলিয়ে বুঝলাম আমার অন্য জরায়ুটি তার নিয়মমতো পিরিয়ড ঘটিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার আমার এই আইডিয়া মন দিয়ে শুনলেন, মনে হল যেন কোথাও একটু আলো জ্বলে উঠেছে। পরের কয়েকবার নানা পরীক্ষা করে বুঝা গেল, আমার চিন্তাটাই ঠিক। যখন পিরিয়ড শুরুর আগের হরমোনজনিত লক্ষণ, আর প্রেগনেন্সি, একই সাথে রাজত্ব করে তখন সৌখিন স্বাস্থ্য পরামর্শকদের আর বলার কিছু থাকে না। মাঝে মাঝে মনে হত ব্যালকনি বেয়ে নেমে যাই, বা কাউকে মেরে ফেলি। অযথা প্রচন্ড কান্না আসতো। কেন বলছি এসব? বুঝাতে পারবো না, কিন্তু এইটুকু জেনে রাখতে পারেন যে একটা মানুষের জয় এর চেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আর কমই থাকতে পারে। ৫। সবশেষে, ডাক্তারদের কাছে সব সমাধান সব সময় থাকে না। যে বোনেরা বা তাঁদের প্রিয়জনেরা এমন পরিস্থিতি দেখবেন, এটা জেনে রাখবেন। ডাক্তার সিদ্ধান্ত নেন নিজের অভিজ্ঞতা বা বইয়ে লেখা আগের অন্যান্য ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে। এমন বিরল ঘটনাগুলো হয়ত তাঁরা কেবল বইয়ে পড়েছেন। আমি যাঁকে পেয়েছিলাম, সে ডাক্তারের ছাত্ররাও বড় ডাক্তার হয়েছে, অথচ তিনিই কেবল বই থেকেই জেনেছিলেন। তবুও আমি কৃতজ্ঞ, আমার ডাক্তার আমার এই অনিশ্চিত যাত্রাটায় আমার সাথে প্রতি পদক্ষেপে নতুন নতুন ব্যপার আবিষ্কার করেছেন। পুরো সময়টা তিনি আমার বিভিন্ন লক্ষণ আর ‘কি মনে হচ্ছে’ এমন কথাগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছেন, আর আমি তাঁর অভিজ্ঞতা আর সূক্ষ্ণদৃষ্টির ওপর নির্ভর করেছি। এই আস্থার জায়গাটা না হলে মানুষ যে তীব্র হতাশায় আচ্ছন্ন হতে পারে, আমি বুঝতে পারি। একজন ডাক্তারই পারেন সেই অনিশ্চয়তা কিংবা আশা হারিয়ে ফেলার জায়গাটা থেকে উঠিয়ে আনতে, মন দিয়ে রোগির কথা শুনতে আর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। সুতরাং আজকের যে আমি, পরিষ্কার ভাষা আর আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলতে পারছি, সেই আমিই লম্বা একটা সময় ধরে লজ্জা, অপরাধবোধ কিংবা নিরাপত্তাহীনতার ধোঁয়া ছাড়িয়ে এসেছি। এসব লিখে ফেলার একটাই কারণ, সচেতনতা তৈরী। যেন একই রকম লক্ষণগুলো নিয়ে অন্য কেউ সমাধানের খোঁজে বিভ্রান্ত হয়ে না যান। প্রতিটি সচেতন মহিলার নিজেকে সুস্থ রাখার, ভালো রাখার অধিকার আছে, আমি এর সাক্ষ্য দিচ্ছি। ভালো কথা, আমি মেডিকেল প্রফেশনাল নই। আশা করি আমার অভিজ্ঞতা কিংবা জ্ঞানকে সেই আঙ্গিক থেকেই বিচার করবেন। আল্লাহ আমাদের ভালো রাখু...।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন