অনির্ধারিত

বিষমবাহু ত্রিভূজ (পর্ব এক)

বিষমবাহু ত্রিভূজ (পর্ব এক)

দৃশ্যপট-১

রুনা একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায় ‘নারীর অধিকার ‘ নিয়ে কাজ করতো। শিক্ষাজীবন থেকেই তার স্বপ্ন ছিল সমাজের নির্যাতিত নারীদের জন্য কিছু একটা করবে সে।। পড়াশোনা শেষে তাই সে তার পছন্দের পেশায় যোগ দেয়। দুই বছর বেশ আনন্দ নিয়েই কাজ করছিল রুনা। এর মধ্যে ওর ফেসবুকে পরিচয় হয় ব্যবসায়ী মারুফের সাথে। আধুনিকমনস্ক মারুফ কথা দিয়েছিল ,বিয়ের পরও চাকুরী করতে কোন সমস্যা হবে না রুনার। তাই পারিবারিক সম্মতি নিয়ে বিয়ে করে ওরা। বিয়ের পর চাকুরী, সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু বিয়ের দুই বছরের মাথায় রুনা যখন সন্তানের মা হয় তখন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় সে। ওদের অফিসে ডে-কেয়ার সেন্টার নেই। এদিকে রুনা’র মা নিজেই চাকুরীজীবী, দীর্ঘদিনের চাকুরীজীবনের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছেন, এখন চকিুরী ছাড়ার সুযোগ নেই।। রুনার নিজের শ্বাশুড়ীও বেঁচে নেই। গৃহকর্মীর কাছে বাচ্চা রেখে বড় করলে সেই বাচ্চার সুস্থ মানসিক গঠন কতটা ব্যহত হয় কলিগদের কাছে এরকম উদাহরণ বহুবার শুনেছে সে। তাই সব দিক বিবেচনা করে সন্তানের স্বার্থে চাকুরীটা ছেড়েই দিল রুনা। নারী হিসেবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্য দুজন নারীর (মা এবং মেয়ে) অধিকার হরণ করতে চাইল না সে । বরং নিজে আত্মত্যাগ করে নিজের ক্যারিয়ারটা বিসর্জন দিল।

এরপর আট বছর কেটে গেছে। রুনার সন্তান এখন স্কুলে যায়। সন্তানকে একাডেমিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত শিক্ষা সব নিজেই দেয় রুনা। চেষ্টা করছে নিজের শিক্ষিত হওয়ার সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সন্তানকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। এর মধ্যে রুনার ছোট বোন মিনা ডাক্তারী পাশ করে একটি হাসপাতালে জয়েন করেছে। ডাক্তার হয়ে সে চায় মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে নারীদের জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে অবদান রাখতে। কিন্তু বিয়ের পর মিনা নিজেই এখন সন্তানসম্ভবা। ওর স্বামী নিজেও ডাক্তার। শ্বাশুড়ি থাকেন গ্রামে, রুনা-মিনার মা’র বয়স হয়েছে। ছোট বাচ্চার সার্বক্ষণিক যত্ন নেয়ার অবস্থা নেই তার। এই অবস্থায় ক্যারিয়ার না সন্তান কোনটাকে বেছে নিবে এই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে মিনা।

বোনের এই অবস্থা দেখে নিজের আট বছর আগের কথা মনে পড়ে যায় রুনার। ও নিজেও তো এরকম দোটানায় পড়ে নিজের ক্যারিয়ারটাকে বিসর্জন দিয়েছিল। আজ ছোট বোনও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন । কিন্তু ও চায় না বোনের জীবনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক। তাই বোনকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল রুনা। বোনকে বলল, “তুই কোনো চিন্তা করিস না। তোর বাচ্চার দেখাশোনা আমি করবো। আমার বাচ্চা তো এখন মোটামুটি বড় হয়ে গেছে। আমার বিল্ডিং এ তোর জন্য বাসা দেখবো। একই বিল্ডিং এ থাকলে তোর বেবিকে আমার কাছে রেখে নিশ্চিন্তে হসপিটালে যেতে পারবি ,তোর সার্ভিস পেয়ে সমাজের অনেক নারীও উপকৃত হবে।”

বড় বোনের কাছ থেকে এই আশ্বাস পেয়ে মিনার বুক থেকে যেন দুশ্চিন্তার একটি ভারী পাথর নেমে গেল! মা চাকুরীজীবী হওয়ার সুবাদে এই বড় বোনের তদারকিতেই বড় হয়েছে সে, বিয়ের আগ পযন্ত বোনই ছিল তার সকল ভরসার জায়গা। তাই বোন যখন তার সন্তানের দায়িত্ব নিতে রাজী হয়েছে তখন আর কোন চিন্তা নেই ওর। আপু যে নিজের সন্তানের মতোই যত্ন করবে ওর সন্তানেরও এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই মিনার। নিশ্চিন্তে তাই একটা ঘুম দিল ও। এদিকে ছোট বোনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুনা ভাবল, “ ক্যারিয়ার বিসর্জন দেয়ার যে কি কষ্ট তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আমি না পারলেও আমার বোন যেন পারে তার কাজ দিয়ে সমাজের জন্য অবদান রাখতে।”

দৃশ্যপট-২

স্বামী, দুই সন্তান আর বিধবা শ্বাশুড়িকে নিয়ে ইরার সুখের সংসার। ইরার স্বামী জনি একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকুরী করে। দেশের একটি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো একটি বিষয়ে মাস্টার্স করলেও ইচ্ছা করেই চাকুরি করেনি ইরা। নিজের শিক্ষাকে সুসন্তান তৈরিতে কাজে লাগাবে এটাই ইচ্ছে ছিল ওর। সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো জনি হঠাৎ অফিসে ব্রেন স্ট্রোক করলো। অফিসের সহকর্মীরা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীরের এক পাশ প্যারালাইসিস হয়ে গেল জনির। এক মাস থাকার পর হাসপাতাল থেকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হলো জনিকে। সপ্তাহে দু’দিন রেগুলার ফিজিওথেরাপি করাতে হবে, তাহলে হয়তো ধীরে ধীরে আবার সুস্থ হবে জনি। কিন্তু সেজন্য ঠিক কতদিন লাগতে পারে এমন কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারল না ডাক্তাররা।

এভাবে প্রায় ছয় মাস কেটে গেল। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি দেয়ার ফলে জনির শারীরিক অবস্থা এখন আগের চেয়ে ভালো। বিছানায় শুয়ে থাকলেও কথা বলতে পারে, হাত-পা নাড়াতে পারে। তবে সুস্থ হয়ে আবার কবে অফিসে যেতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। এদিকে ছয় মাস যাবৎ চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে জমানো টাকা সব শেষ। চাকুরীটা থাকলেও অফিসে জয়েন না করা পর্যন্ত আর বেতন পাবে না জনি। সংসারের নিয়মিত খরচ, জনির চিকিৎসার খরচ কিভাবে চালাবে এই চিন্তায় দিশেহারা হয়ে গেল ইরা। আত্মীয়, বন্ধুদের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় চাকুরীর জন্য CV দেয়া শুরু করল সে। অভিজ্ঞতা নাই বলে entry level এ চাকুরী করতেও সমস্যা নেই এটা CV তে উল্লেখ করল সে। অবশেষে ছাত্রজীবনের এক বান্ধবীর সহায়তায় ওর অফিসেই কাজ পেল ইরা। বেতন যদিও আশানুরূপ নয়, তবু বিপদের দিনে এখন এটাই ভরসা।

চাকুরী শুরু করার পর জীবনে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলো ইরা। প্রতিদিন অফিসে যাওয়া- আসার পথে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে পরিবহনের জন্য অপেক্ষা করা, রাস্তায় যানজটে সময় নষ্ট, কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বসের কাছে নিজের কর্মদক্ষতার প্রমাণ দেয়া, পুরুষ সহকর্মীদের অতিরিক্ত সহানুভূতিকে উপেক্ষা করা , নারী সহকর্মীদের মেয়েলী গল্পের সাথে তাল মিলাতে না পারা ---এরকম বহুমুখী সমস্যার সাথে মোকাবেলা করতে করতে ইরা ইদানীং অনুভব করে , ঘরে ছিল বলে বাইরের কর্মজীবনের কত বিচিত্র রূপ এতদিন অজানা ছিল ওর কাছে! জীবনের রূঢ় বাস্তবতা আজ তাকে বুঝিয়েছে,চাকুরি মানে শুধু ক্যারিয়ার বা অর্থ উপার্জন নয় বরং অনেক ধরনের শারীরিক ও মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতাও থাকতে হয় একজন কর্মজীবী নারীকে। প্রতিদিনের দৌড়-ঝাঁপে ক্লান্ত ইরা তাই মাঝে মাঝেই ভাবে, নিজের সাজানো সংসারে ঘরকন্না করে এতদিন কতই না ভালো ছিল সে। নিজের বস ছিল সে নিজেই। নিজের বানানো রুটিনে স্বাধীনভাবে নিজের কাজগুলো গুছিয়ে করতে পারত সে। পুরনো সেই সুখী দিনগুলোর কথা ভেবে নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে ওর।

                                  (চলবে ইনশাআল্লাহ)


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন