ভাবছিলাম, আমার মা আমাকে কিভাবে পর্দা করতে রাজি করেছিলেন? আমি আসলে আগে থেকেই খুব দেখতাম, মা আর বড় বোনকে। সম্ভবত বড় হতে হতে চোখ এতোই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলো যে, ‘কেন পরে বাড়তি কাপড়টা?’ এই প্রশ্ন আসেইনি মনে। আব্বুর আধা সরকারী চাকরী, একমুখী কাজ। আব্বু ফিরতে ফিরতে যে ঘরটা খুব গোছানো সুন্দর হয়ে যায়, সকালে বা দুপুরে তা থাকে না। আমরা পাঁচ ভাইবোন স্কুলে, কলেজে যাই। আম্মু খাবার বানিয়ে খাইয়ে স্কুলে রেখে এসে বাকি দিনের রান্নার যোগাড় করেন। আবার ঘর নিপাট নিভাঁজ করে আমাদের কাউকে আনতে, কাউকে দিতে যান। এক ফোঁটা ফাঁকি দেয়ার জো নেই, না পড়ায়, না স্কুলের সামনে ফুচকাওয়ালার গাড়িতে। আম্মু এই কাজটা না করলে আজকে আমিও করতে শিখতাম না, আর হয়ত অযত্নে অবহেলায় বখে যেতাম। নিজে তো পরতেনই, আম্মু বুঝালেন, এই যে বাড়তি কাপড়টা আমাকে আটকে রাখার জন্য পরতে বলা হয় নি। আমি বাইরে যাবো বলেই এর বিধান। যেন আমিও সহজে দরকারের কাজটা করতে যেতে পারি। আমিও দেখলাম, কথাটা সত্যি। বাসার সামনের কোণাটা থেকে শুরু করে স্কুলের সামনের জটলা, কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ করতেও হচ্ছে না, কেউ আমার আসা যাওয়ায় অত পাত্তাও দিচ্ছে না।
সমাজ সবার। দায়িত্ব কর্তব্য সবার আছে, সে বোধ সবার নাই। কেউ তার চোখ নামানোর দায়িত্বে ঢিল দিচ্ছে বলে আমি আমার দায়িত্বে যেমন অবহেলা করতে পারি না, তেমন পারি না তার ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিতে। আমার সাত বছর বয়সে আব্বু দেশের বাইরে গেলেন। কতবার চাল এনেছি পাঁচ কেজি, মনে আছে। মাছওয়ালা, সবজিওয়ালা ডাক দিতাম। মাথায় তিনকোণা একটা আবরণ, বুঝিয়ে দিতে, আমি কারও ঠাট্টার প্রত্যাশী নই। দেখতাম, আমার অসমসাহসী দাদী ঠিক সমান সমান দুইটা ছয়বাটির টিফিন ক্যারিয়ার হাতে করে আম্মু আর বড় ফুফুর জন্য রান্না করে ট্রেনে করে বাড়ি থেকে চলে আসতেন। একা। কালো পর্দায় আপাদমস্তক ঢাকা, শীর্ণ হাতে অসুরের শক্তি। ডিসিকে ধমকানো, দুরভিসন্ধি নিয়ে বাড়িতে আসা টিএনওকে চড় মারা সে হাত, কার সাধ্য এ মহিলাকে ঘাঁটায়?
এক জ্ঞানী মুরুব্বির কাছে যাই মাঝেমাঝে। প্রশ্ন করতে। উনার কাছে যাবার নিয়মই তাই, প্রশ্ন নিয়ে যেতে হবে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সচিব। এনবিআরের প্রধান নির্বাহী ছিলেন। একদিন জিগেস করলাম,
-ইসলাম যে বিধান দেয়, তাতে কি নারী আর পুরুষের সম্পর্ক খাবার আর খাদকের?
-না। আল্লাহ বলেছেন, এ সম্পর্ক সহযোগীর।
-তাহলে পর্দার কথা বলতে গিয়ে নারীকে যে ঠিক সেভাবে দেখানো হয়?
-আম্মা, শুনেন। পুরুষ মানুষের মনের গঠন এক রকম, আপনাদের মনের গঠন আর এক রকম। এজন্য তাঁদেরকে বলা হয়েছে, অধিকার বহির্ভূত দৃষ্টিপাত না করতে। আর আপনাদেরকে বলা হয়েছে, বাইরের কোন পুরুষ যদি তাকায়ও, তার মনের রোগ বাড়ার মত কাপড় না পরতে, আচরণ না করতে। আর এ সংক্রান্ত আয়াতের শেষে আল্লাহ নিজেই বলেছেন, আল্লাহ সব জানেন। আপনারা কে কি করেন আম্মা, সেটা আল্লাহ জানেন। আল্লাহর কথা শুনেন যদি, আল্লাহকে খুশী করার জন্য করবেন। কারণ এমনকি মদীনায় নিজের শাসনামলেও আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন মহিলাকে বের হতে নিষেধ করেন নাই। বরং বলেছেন, কোন মহিলা মসজিদে আসতে চাইলে তাকে বাঁধা না দিতে। ওরকম খাদ্য খাদকের সম্পর্ক হলে তো ক্ষমতা পেয়েই প্রথমে মহিলাদের পা ঘরের দরজার বাইরে আসতে নিষেধ করে দিতেন।
চাচাজানের কথায় মনে শান্তি নিয়ে ফেরত এসেছিলাম। কিছুদিন পর পড়লাম, ‘রাসুলের (সা) যুগে নারী স্বাধীনতা’। আর এখন কাজ করছি মাওলানা আকরাম নদভীর ‘আল মুহাদ্দিসাত’ নিয়ে (এই লেখা ২০১৯ এর)। মাঝেমাঝে শ্রদ্ধামিশ্রিত বিষ্ময় নিয়ে দেখি, কি সুন্দর এক বিধান আল্লাহ দিয়েছিলেন, মায়াময় পালনকর্তার মত বিপদের জায়গাগুলো দেখিয়ে দিয়েছেন। মাঝেমাঝে অপার মায়ায় দেখিয়ে দিয়েছেন, একটুউ কষ্ট করে এইটুকু করলে তিনি আরও একটু খুশী হবেন। যেন একটা পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি। কোন দিক চোখ এড়িয়ে যায় নি, কোন একটি প্রবৃত্তিকেও মেরে ফেলতে বলে নি। বরং পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, কি করে তৃপ্তির সাথে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করা যায়। অপরাধবোধ নিয়ে মাথা নিচু করে না, বরং আত্নবিশ্বাস নিয়ে মানবিক সত্ত্বাকে এক আল্লাহর সামনে ছাড়া আর সব জায়গায় কি করে উন্নত রাখা যায়। কি করে ইচ্ছেগুলোর মধ্য থেকে শয়তানের কালো ছায়াকে আলাদা করে চেনা যায়, ছুঁড়ে ফেলা যায় দূরে।
এবার একটা কথা। উপমহাদেশের পুরুষদের এক আজন্ম লালিত আতঙ্ক আছে। ‘মেয়েদের ছেড়ে দিলে অতি বাড় বেড়ে যাবে। না যাবে সামলানো, না যাবে ঠেকানো। সমাজ রসাতলে যাবে।’ অনেকে আবার ভাবেন, ‘পুরুষেরা কত খারাপ, আমি নিজে পুরুষ হয়ে জানি। সুতরাং করণীয় হল, নারীকে ঘরেই থাকতে বলা।’ ইত্যাদি। নারীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত পুরুষ, তার স্বামীকে নিয়ে বইমেলায় আসতে বলেও তথাকথিত ধার্মিকদের তোপের মুখে পড়ছে অনেক জ্ঞানপিপাসু মানুষ। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই অমূলক আতঙ্ককে ধর্মের নামে নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের, তাঁর পরবর্তী খুলাফায়ে রাশেদিনের সময়কার এবং এমনকি আব্বাসীয় কিংবা উসমানী শাসনামলের সুবিশাল ইতিহাস অনুবাদই করা হয় নি। ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই সমাজকে একদম ধুয়েমুছে তকতকে করে ফেলা যায় নি, দুষ্কৃতিকারীরা ছিলোই। তবুও কোন পরাক্রমশালী কিংবা অতি বড় ধার্মিক শাসকও নারীকে ঘরে আটকে রাখার নিয়ম জারি করতে পারেন নি। কারণ আল্লাহই নিজের দক্ষতাকে সমাজের কাজে লাগানোর জন্য, কিংবা প্রয়োজনে নারীকে পর্দার আবরণে সুরক্ষিত হয়ে বের হবার সুযোগ দিয়ে রেখেছেন।
শুরুর কথাটা দিয়ে শেষ করি। আল্লাহ ইসলামকে দিয়েছিলেন স্বাস্থ্যবিধির মত। কি কি খেলে উপকার, কি কি খেলে ক্ষতি, এক টুকরা কিংবা এক ফোঁটাও খাওয়া যাবে না কি কি, ঠিক যেন এমন। মানুষের কাজ নিজের এলাকা, সমাজ বুঝে সে বিধির আলোকে নিজস্ব মেন্যু তৈরী। আর ব্যক্তি মুসলিমের কাজ, সে মেন্যুর নিয়মে যথাসম্ভব নিখুঁত রেসিপি মেনে কাজটি করা। অথচ কি হচ্ছে? একজন, নিজের বুঝমত রান্না করে সেটাকে সেই স্বাস্থ্যবিধিতে সিদ্ধ করতে চেষ্টা করছে। কোন দিক দিয়ে কমতি আছে? ভুল আছে? না, রেসিপি না, খোদ স্বাস্থ্যবিধিকেই ভুল ব্যখ্যা করে অথবা লুকিয়ে বা জেদ দিয়ে দমিয়ে রেখে ইচ্ছে মত মিলিয়ে নিচ্ছে। শুধু তাই না, সেই খোঁড়া রেসিপিতে রান্না না হলে বাকি সব অসিদ্ধ, ভুল, এই রায়ও দিয়ে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, আজকে মুসলিম জাতিও ইহুদি বা খ্রিষ্টানদের মত দ্বীনকে পরিবর্তন করার দায়ে দায়ী। দুঃখজনক হলেও সত্যি, যে ‘বিকৃতির আশংকায় সত্যকে লুকানো’র এই ভয়ংকর কাজটিতে সবচেয়ে বেশি দায়ী এক শ্রেণীর আলেম। মজার ব্যপার, চোখ যেমন নিজেকে দেখে না, সারা দুনিয়া দেখে, নিজের ভুলও নিজের চোখে আটকায় না। এই জ্ঞানপাপিরাই অন্যদের আদর করে ‘মডারেট’ বলেন। আর নিজেরা নিজ উদ্ভাবিত রেসিপির দারোগাগিরি করেন।
গ্যালিলিও গির্জার রাহেবদের চাপে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, ‘ না না ভুল বলেছিলাম। পৃথিবী স্থির, বাকি সব গ্রহ তাকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে’। সাক্ষ্য শেষে আদালতের দরজায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘তবুও তো পৃথিবী ঘুরছে’। সত্য এত সুন্দর, সত্য এক দিন না এক দিন আপন আলোতেই উদ্ভাসিত হয়। ভুল ব্যখ্যাধারীদের সাক্ষ্যের ধার ধারে না, ভুল বুঝে নত হওয়া মস্তকেও আলোর মুকুট পরায়।
Facebook Comments