সন্তান অথবা পণ্য অথবা সিঁড়ি
লিখেছেন Jummy Nahdia, জুলাই 16, 2020 4:18 অপরাহ্ণ

(পাঁচ বছর আগের একটা পুরনো ফেসবুক পোস্ট আমার। আরও কয়েক বছর আগ থেকে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করছিলাম কেন কন্যা জন্মালে নারীরাও মহা ব্যথিত হন! যেহেতু এই নারীদের কারো কারো বিশ্বাস পুরুষই হচ্ছে একমাত্র সুবিধাভোগী শ্রেনী- তাই নিজের মর্যাদার সিঁড়ি হিসেবে পুত্রের আকাঙ্ক্ষা করেন তাদের কেউ কেউ। এর বাইরেও এত কষ্টের সে সন্তান জরি চুমকির আড়ালে মাথা নীচু জীবন- অপদস্থ আর অপমানের জীবনের মুখোমুখি হবে ঠিক তারই মতন, সেই অলাতচক্রটা নিশ্চিত ভেবে নেন হয়ত।)

এমনিতে সিক্রেট এবং সারপ্রাইজ পছন্দ করলেও একটা দুইটা বিষয়ে এসবের কথা আমার মাথায় থাকেনা। যেমন, নিজের ভেতর বেড়ে উঠতে থাকা মানুষটা মেয়ে না ছেলে এটা আমি খুব আগ্রহ নিয়ে ডক্টরের কাছে জানতেও যেমন আগ্রহী ছিলাম, যে কেউ জানতে চাইলে জানাতেও দ্বিধা করিনি।

নিউট্রাল মন্তব্যের পাশাপাশি রেসিস্ট মন্তব্যও আল্লাহ দিলে একবারে খারাপ ভাগে পড়েনি। আনন্দের না বিষাদের জানিনা, নারীদের কাছ থেকেই মূলত আমার এই রেসিজমের অভিজ্ঞতা।

– ছেলে হবে? খুবই ভাল খবর। আমি আবার ছেলে-মেয়ের পার্থক্য করিনা তবে প্রথম বাচ্চা ছেলেই সুন্দর। সিস্টেম মত আর কি।

(এরপর আমি আসমান হাতড়িয়ে সিস্টেম বোঝার চেষ্টা করতেছিলাম।)

-শুনলাম তোমার নাকি ছেলে হবে? যাক আলহামদুলিল্লাহ!
-ক্যান মেয়ে হলে আলহামদুলিল্লাহ বলতেন না?
-না তা কেন? তবে মেয়ে হলে অনেক যন্ত্রণা। বিয়ে দিতে কত কষ্ট!
-ছেলে বিয়ে দিতে কষ্ট নাই?
-ছেলে হল পুরুষ মানুষ। কালো হোক, খাটো হোক পুরুষ মানুষের দামই আলাদা।

আমি যেন কমদামী এক মহিলা, আরেক কমদামী মহিলার এই মূল্যবান মন্তব্য শোনার পর মোটামুটি কল্পনার জগতে হারিয়ে গেলাম।

নিজেকে আবিষ্কার করলাম প্রচুর গয়না, চুমকি পাথরের শাড়িতে জর্জরিত হয়ে দৌড়াদৌড়ি অবস্থায়। সৌখিন মধ্যবয়সী আমি। মুখে পান নিয়ে ঐ বাড়ির পাঠানো ভেট কাতল মাছের সাইজ নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করছি।

পিচিক করে পিক ফেললাম।

– আমার রাজপুত্র ছেলের- লাখে একটা ছেলের কপালে কোন কিপ্টা ঘরের মেয়ে জুটল বুঝতেছিনা! কওছে, এইটা পোণা মাছ না কাতল মাছ?

উত্তর এলো পোনাও এর চেয়ে বড় হয়।

আমার প্রেসার গেল হাই হয়ে। লাখে একটা ছেলে আমার! ফার্নিচার থেকে শুরু করে স্যুট- ঘড়ি কিছুই মনের মত হয়নাই। দাঁড়িপাল্লার এক নিক্তিতে ছেলেকে বসাই…অন্য নিক্তিতে কালোকুলো নতুন বউ, মাছ, মিষ্টি, পাঞ্জাবী- স্যুট, খাট-পালঙ্ক বসাই। প্রেসার আর নামেনা। ছেলের পাল্লাই বেশী ওজনদার ঠেকে। বাকি সব হালকা।

আবার সেই ঝকঝক ঝকঝক শাড়ি গয়নায় জবুথুবু হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কোথাও দৌড় দিলাম। অন্য কোথাও। তবে এবার মাথাটা বেশ নীচু। টেনশনে কপালের শিরা দপদপ করছে। জিনিসপত্রগুলো পছন্দ হবে তো? এত দেখে শুনে দাম দিয়ে ফ্রিজটা টিভিটা কিনলাম। দেখা গেল ঠিকই ভুল বের করে ফেলবে। এমনিতেই মেয়েটার আমার গায়ের রঙ চাপা, লম্বাও কম। এর ভেতর জিনিসপত্রে খুঁত পেলে কথার বিষে একবারে ঝাঁঝরা করে ফেলবে…!

গা ঝাড়া দিয়ে কল্পনার রাজ্য থেকে হাটকে মাটকে বের হওয়া দরকার। পেটে হাত বুলিয়ে আমার প্রিয় সত্য এবং বাস্তবকে অনুভব করেছিলাম। খামাখা প্রোডাক্ট কেন জন্ম দেব আমি, হ্যা? এত কষ্ট করে ভাল দামে বিকোবার জন্য একটা প্রোডাক্টের জন্ম দেয়ার কোন কারণ তো আমি খুঁজে পাইনা। বিয়ে শাদী জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- কিন্তু এইটা মানব জীবনের মূল উদ্দেশ্য না। ইসলামিক্যালি মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য আল্লাহর ইবাদত যদি মানি তাহলে বিয়ে ইবাদতের অসংখ্য দিকের মধ্যে একটা।

কিন্তু সমাজ সংসার তার নিজস্ব বিয়ে কেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা- থিওরি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে একটা মানুষের জন্মানোর আগে থেকেই আচরণের মাপকাঠি ঠিক করে ফেলে দিয়েছে। ছেলে হলে এক রকম, মেয়ে হলে আরেক রকম। মেয়ে আবার সুন্দর হলে এক, কালো হলে এক (সুন্দরের বিপরীত শব্দ হচ্ছে কালো…মানেন আর না মানেন, শিক্ষিত- অশিক্ষিত উভয় শ্রেনীর ভেতর মন চাইলে জরীপ চালাতেও পারেন।)

সমাজের জন্য হয়ত বাস্তব তবে আমার জন্য কল্পনাগুলো খুব অলীক কল্পনাই থাকুক। ওগুলোকে শক্তি দিয়ে গর্তে ছুড়ে ফেলেছি আমি।

তারচেয়ে বরং মানুষটা আমার চোখের শীতলতা এনে দিক। তার বেড়ে ওঠা হোক আশরাফুল মাখলুকাতের মত। অদ্ভুত সমাজের নিয়ম কানুন আর লৌকিকতার বলী সে হবে না- এবং অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াবে।

Photo Courtesy of Quaint Baby Art/Laura Steerman

Facebook Comments
পোস্টটি ১০৩৬ বার পঠিত
 ০ টি লাইক
০ টি মন্তব্য

আপনার মুল্যবান মন্তব্য করুন

Facebook Comment